শোনা গেছে, স্বগোত্রীয়দের হাতে মার খেয়েছেন কারো ব্যক্তিগত মুহূর্তের ছবি তুলে তা সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে প্রকাশ করে আলোচনায় আসা ফটোসাংবাদিক জীবন আহমেদ। কী বিচিত্র এক রাজ্যে এসে আমরা উপনীত হয়েছি যে এখানে কারো দোষগুণের বিচার এখন আইন-আদালত পর্যন্ত গড়ায় না। অমানুষের হাতে এখন গণআইন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি থেকে তোলা চুমুর ছবিতে দেখা যাওয়া পাত্রপাত্রীর যদি অধিকার ক্ষুণ্ণ হয়ে থাকে, তবে সবার আগে অভিযোগ করার কথা তাঁদের। কিন্তু না, তাঁরা সব জেনেবুঝেও এখন নিশ্চুপ, অথচ আমরা যাঁরা ‘পাড়া-প্রতিবেশী’ তাঁদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে।
আবার রক্ষণশীল আরেকপক্ষ ছবিটি ভুল প্রমাণের জন্য উঠেপড়ে লেগেছে। যেন একটা চুমুতেই তাদের সমাজ-সংস্কৃতি তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়েছে। এদের সতীর্থরাই হয়তো জীবনকে মারপিট করে ডায়ালগ দিয়েছে গেছে, 'জীবন, তুই সাংবাদিক নামের কলঙ্ক!'
বাঙালি এক অদ্ভুত চৈতন্য লালন করে। তারা কথায় ও চর্চায় খুব ধার্মিক। নিয়মিত নামাজ পড়ে, কোরবানি দেয়, ফি বছর হজব্রতও পালন করে। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অনেকে ঘুষ খায়, সরকারি অর্থ লোপাট করে, ব্যবসায়ী তার পণ্যে ভেজাল দেয়, তারপর আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে যায়, আমোদ ও ভোগে ডুবে যায়। আরেক দল আছে খুন-ধর্ষণে খুব পটু। যখন তখন জোরজবরদস্তিতে নারীকে অসম্মান করে, যৌন হয়রানি করে। ঢাকার জনগুরুত্বপূর্ণ কোনো চত্বরে যদি ইউরোপের মতো গ্রিক সৌন্দর্যের দেবী উন্মুক্ত বক্ষা ভেনাসের ভাস্কর্য স্থাপন করা হতো, তবে এরা যুবা-বৃদ্ধ নির্বিশেষে ওই ভেনাসের অঙ্গেও পেরেক ঠুকত, এটা নিশ্চিত থাকতে পারেন। এমন ধারার শুদ্ধ মানুষেরাই মেঘলা দিনের একটি শ্রাবণ চুম্বন সহ্য করতে পারছে না। এদের নৈতিক মানদণ্ড বা মৌল আদর্শ বলে কিছু না থাকুক, এরাই আজ বড় নীতিবাগিশ!
জীবনের ছবিটি যদি ফটোশপও হয়ে থাকে, তবু মানবীয় সম্পর্কের নিরিখে এর একটি বড় শিল্পমূল্য আছে। ট্যাবু ভাঙার আবেদন আছে। ছবিটির ক্যাপশানে জীবন লিখেছিলেন, 'বর্ষামঙ্গল কাব্য, ভালোবাসা হোক উন্মুক্ত!' এই শিরোনামটাই ছিল এই শিল্পের নিরেট উদ্ভাস। অথচ এই ছবিটিই কি না অনেকের রক্ষণভাগের অন্ধ মুখোশ খসিয়ে ফেলল।
আমরা কখনই বলব না, সমাজ তার নিজস্ব মূল্যবোধ হারিয়ে ফেলুক। নারী-পুরুষের একান্ত অন্তরঙ্গতা উন্মুক্ত হয়ে পড়ুক। কিন্তু চুমুর মতো মধুরতম ভালোবাসা প্রকাশের স্বাধীনতা থাকা উচিত। সৌদি রাজা-বাদশা কিংবা ফার্স্ট ওয়ার্ল্ডের রাষ্ট্রনায়করাও নারী-পুরুষ নির্বিশেষে চুম্বন করেন, আলিঙ্গন করেন। সেটা কারো কাছেই দৃষ্টিকটু লাগে না। কাজেই টিএসসিতে প্রাপ্তবয়স্ক কোনো শিক্ষার্থী যদি ভালোবেসে একে অপরকে চুমু খেয়ে থাকে, তাতেও মহাভারত অশুদ্ধ হয়ে যায় না। বরং আমরা এখানে মানবীয় সম্পর্কের স্বতঃস্ফূর্ততা দেখেছি। যেমনটা দেখা মেলে শিল্পসাহিত্যে। মানুষ যা নিয়ে বাঁচে সেই সম্পর্ক এবং শিল্পসাহিত্য আমরা কিছুতেই অস্বীকার করতে পারব না। ধর্মান্ধতা ও গোঁড়ামি দিয়ে পৃথিবী চলে না।
এটা অতি অবশ্যই ধর্তব্যের যে কারো অনুমতি না নিয়ে তাদের ব্যক্তিগত ছবি তোলা যায় না। এই ইথিক্স ও এটিকেট যদি জীবন আহমেদ ভঙ্গ করে থাকেন এবং ভুক্তভোগীরা যদি অভিযোগ করে থাকেন, তাহলে দেশের প্রচলিত আইনে তার বিচার হতে পারে।
বাঙালির উচিত দৃষ্টিভঙ্গিটাকে সুদূরপ্রসারী করা। বিজ্ঞানীরা যখন মঙ্গলগ্রহে পাড়ি জমানোর বন্দোবস্ত করছে, আমরা তখন ধর্মগ্রন্থে বুঁদ হয়ে থাকছি। আধুনিক বিজ্ঞান কিংবা সাহিত্যের মানবিকবিদ্যা আমাদের টানে না। কালো কাপড়ে চোখ-মুখ ঢেকে রেখে অন্ধকার হাতড়ে বেড়ানোদের কাছে তাই একটি সামান্য চুম্বনই আলোচনা ও ধ্যানজ্ঞানের একমাত্র আলোচনার বিষয় হয়ে ওঠে। কার্যত এই হলো আমাদের অন্ধকার বাঙালি মানস। এখানে আর কি আলো আসবে?
লেখক : সংবাদকর্মী, মাছরাঙা টেলিভিশন।