মঈন চিশতী
দিন দিন লোক সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু মানুষ কমে যাচ্ছে। কোথায় যেন এ লেখাটি পড়ে আমার নজর আটকে যায়। সত্যিই তো। সব জায়গায়ই লোকে লোকারণ্য, কিন্তু সেখানে প্রকৃত মানুষ মেলা ভার।
শুধু দু’পা দু’হাত থাকলেই মানুষ হওয়া যায় না। আল্লাহ বলেন, ‘উলায়িকা কাল আন আম তারা হল পশু সদৃশ’। আপনি ব্যস্ত শহরে-গঞ্জে যেখানে তাকাবেন দেখবেন মানুষ আর মানুষ। কিন্তু প্রকৃত মানুষ কে তা সাহেবে আসরারগণই জানেন কিন্তু সমাজে ফেতনা হবে বলে তা প্রকাশ করেন না। জামালুল কুলুব নামক কিতাবে আছে মোগল আমলে দিল্লির শাহি জামে মসজিদের ইমাম প্রত্যেক দিন একটি দোকানে গিয়ে পান খেতেন।
একদিন দোকানদার দোয়া চাইলে ইমাম দোয়া করলেন ‘ইসকো ইনসান বানাদো আল্লাহ। হে আল্লাহ একে মানুষ বানিয়ে দাও’। দোকানদার প্রতিদিনই দোয়া চায় ইমামও একই দোয়া করেন।
একদিন বিনয়ের সঙ্গে দোকানদার প্রশ্ন করল হুজুর আমি দোয়া চাই আমার ব্যবসায় উন্নতি হওয়ার জন্য। কিন্তু আপনি দোয়া করেন আমাকে মানুষ বানিয়ে দেয়ার জন্য। আমার মা মানুষ, বাবা মানুষ, আমি মানুষ।
তাহলে এ দোয়া কেন? ইমাম মুচকি হেসে তার মাথার পাগড়ি খুলে দোকানদারের মাথায় দিয়ে বললেন চোখ বন্ধ করে বল কী দেখতে পাও? দোকানদার চিৎকার দিয়ে বলে খোদার কসম, সারাটি দুনিয়া হাতের তালুর মতো দেখতে পাচ্ছি। সমগ্র দুনিয়া পশুতে ভরপুর। অনেক দূরে দু-একজন মানুষ দেখা যায়। কারও অর্ধেক শরীর মানুষের বাকিটা পশুর সুরত।
এখন আমি বুঝতে পারছি, কেন আপনি দোয়া করেন আমাকে মানুষ বানিয়ে দেয়ার জন্য? এই কোটি কোটি পশুর মধ্যে আমি কী ধরনের পশু, তা দেখতে চাই। ইমাম এবার তার টুপিটা দোকানদারের মাথায় দিলেন।
দোকানদার নিজেকে একটি বানর আকৃতিতে দেখতে পায়। ইমাম বলেন, আমি যখন পান খেতে আসি দেখি একটা বানর বসে পান বিক্রি করছে আমি পান কিনলেই বলে, আমার জন্য দোয়া করুন। তাই দয়াপরবশ হয়ে দোয়া করি খোদা একে মানুষ বানিয়ে দাও।
ইমাম গাজ্জালীও কিমিয়ায়ে সাআদাত গ্রন্থে বলেন, মানুষের মধ্যে বিভিন্ন পশুসুলভ আচরণ আছে যেমন কেউ বানর স্বভাবের চঞ্চল প্রকৃতির কেউ বিড়াল স্বভাবের লোভী প্রকৃতির। কেউ কুকুর স্বভাবের। কেউ গরু-মহিষ কেউ ঘোড়া-গাধা, কেউ ব্যাঘ্র-সিংহ স্বভাবের।
এ কারণে অনেক সময় তাদের এসব পশুর স্বভাব মানুষের নামের বিশেষণ রূপে আমরা প্রকাশ করি। কেউ সাহসী হলে তাকে বাঘের বাচ্চা সিংহ শাবক বলে আখ্যায়িত করি। লোভী হলে কুকুর বিড়ালের সঙ্গে তুলনা করি। এতে বোঝা যায় প্রাণী হিসেবে আমাদের মধ্যে সব প্রাণীর দোষগুণ বিরাজমান।
তাই সবার আগে তো আমাদের মানুষ হতে হবে। মানুষ হলেই হজ ফরজ। বাগদাদের আবদুল্লাহ বিন মুকাফফাল পেশায় মুচি হলেও প্রকৃত মানুষ ছিলেন, তাই জাহেরিভাবে হজ না করেও মানবসেবার কারণে তার উসিলায় লাখ লাখ হাজীদের হজ কবুল হয়েছিল।
ইমাম বুখারির উস্তাদ আবদুল্লাহ বিন মোবারক বলেন, ‘একবার হজে গিয়ে হজ শেষ করে মুরাকাবায় বসে জানতে পারি এবার বাগদাদের আবদুল্লাহ বিন মুকাফফালের উসিলায় সবার হজ কবুল হয়েছে। আমি তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে দোয়া নেয়ার ইচ্ছা করলেও লাখ লাখ লোকের ভিড়ে কোথায় পাব তাকে? তাই দেশে ফিরে যাওয়ার পথে বাগদাদে গিয়ে তার সন্ধান করলে জানতে পারি তিনি বাজারের কিনারে জুতা সেলাইয়ের কাজ করেন। সেখানে গিয়ে তাকে সালাম দিয়ে বলি হাজী সাহেব হজ থেকে কবে এলেন?
তিনি চোখের পানি ফেলে দিয়ে বলেন, আমাকে লজ্জা দিচ্ছেন কেন? বড় শখ ছিল আমার কর্মজীবনের শুরু থেকে প্রতিদিন এক পয়সা করে জমানো টাকা দিয়ে হজ সম্পাদন করব কিন্তু তা আর ভাগ্যে হল না।
এবারই আমার যাওয়ার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু যাত্রার সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেও যেতে পারিনি। ঘটনাটি হল যাত্রার আগের দিন রাতে আমার বিবির কাছে বিদায় নিচ্ছি কাফেলার সঙ্গে যাত্রা করব। বিবি সাহেবা সন্তানসম্ভবা ছিলেন, বলেন- আপনি তো হজে যাচ্ছেন, পাশের বাড়ি থেকে গোশত সালুনের ঘ্রাণ আসছে। আমার মন চাইছে গোশতের সুরুয়া দিয়ে রুটি খেতে।
এত রাতে তো আর বাজারে গোশত পাওয়া যাবে না তাই তাদের বাড়ি থেকে একটু সুরুয়া চেয়ে আনুন। আমি খেয়ে তৃপ্ত হয়ে আপনাকে বিদায় দিই। আমি সে বাড়ি গিয়ে বিষয়টি বললে তারা জানাল আপনাদের জন্য এই গোশত হালাল নয় কারণ আমরা তিন দিনের অনাহারি। ধনী আত্মীয় প্রতিবেশীরাও আমাদের কোনো খোঁজ নিচ্ছিল না আমরা খেলাম কিনা।
তাই নদীর পার থেকে একটি মরা খচ্চরের গোশত এনে সালুন তৈরি করেছি যা আমাদের জন্য বৈধ আপনার জন্য নয়। কারণ আপনি ধনী। হজে যাওয়ার রাহা খরচ পরিবারের ভরণ-পোষণের ব্যবস্থা আপনার আছে’।
প্রতিবেশীর এ কথা শুনে আমার মনে খেদ হল। হায় নবীজি (সা.) বলেছেন যে ব্যক্তি পেট পুরে খেয়ে ঘুমাল আর তার প্রতিবেশীর খাওয়া পরার খবর নিল না সে মুসলমান নয়। তাই তাওবা করে পরের দিন হজের রাহা খরচ প্রতিবেশীদের বণ্টন করে দিয়ে রোজকার মতো কাজ শুরু করি। আল্লাহ তৌফিক দিলে পরে হজ পালন করব।
প্রতিবেশীর হক নষ্ট করে তো আর হজে যেতে পারি না। আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক বলেন, আল্লাহর কসম আপনার এই ইখলাসের কারণেই এবারকার হজ আল্লাহ আপনার নেককাজের উসিলায় কবুল করেছেন। সবার আগে আমাদের মানুষ হতে হবে। মানুষ হতে হলে আমাদের শৈশব থেকেই মানুষ হওয়ার ট্রেনিং নিতে হবে। কবিগুরু বলেছেন, ‘ছেলেকে মানুষ করতে হলে ছেলেবেলায়ই করতে হবে নতুবা ছেলে ছেলেই থেকে যাবে মানুষ হবে না’।
মানুষের ওপরই ইবাদত-বন্দেগি ফরজ। আল্লাহ বলেন, ‘ওয়া আলান্নাসি হিজ্জুল বাইতি মানিসতাতাআ ইলাইহি সাবিলা। যার সাধ্য আছে রাহা খরচের সে যেন বাইতুল্লাহর হজ করে’।
নবী ইবরাহিমকে (আ.) ‘আজ্জিন ফিন্নাসি লিল হাজ্জি, বলে ঘোষণা দিতে বলেছিলেন। আর খানায়ে কাবাও মানুষের হেদায়েতের জন্য বানানো হয়েছে। আল্লাহ বলেন, ‘ইন্না আউয়ালা বাইতিন উদ্বিয়া লিন্নাসি লাল্লাজি বিবাক্কাতা মুবারাকান ওয়া হুদাল্লিল আলামীন’।
এসব আয়াতে মানুষের কথাই বলা হয়েছে। লোক সংখ্যা যেমন দিন দিন বাড়ছে তেমনি দিন দিন হজযাত্রীর সংখ্যা বাড়ছে কিন্তু প্রকৃত হাজী হচ্ছে ক’জন। হজ হল সদিচ্ছার নাম। কিন্তু হজ শেষে আমরা আগে যেমন ছিলাম তেমনই রয়ে যাই। সাইয়েদুদ তায়েফা হাসান বসরীর মতে হজ কবুলের নিদর্শনই হল ইবাদত-বন্দেগির প্রতি আগ্রহ বেড়ে যাওয়া। আর ঘৃণাা পাপ কাজের প্রতি অনাগ্রহ সৃষ্টি হওয়া।
১৩ জিলহজ তিন শয়তানকে কঙ্কর মারার মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে গেল হজ কার্যক্রম। আমরা হাজী হলাম বটে, মক্কা মদিনার খাদেমরা আমাদের ইয়া হাজ্জী ইয়া হাজ্জী বলে সম্বোধন করে সম্মান জানিয়েছেন। অনেকের নামের আগে হাজী, আলহাজ ইত্যাদি লেখা হবে। নামের পরিবর্তনে আমরা সবাই সচেষ্ট। কিন্তু মনের পরিবর্তন হল কী হল না আসুন না একবার নিরিবিলি চোখ মুদে ভেবে দেখি। নাকি আগে যেমন ছিলাম তেমনই আছি।
যদি তাই হয় তবে আমাদের হজের প্রাপ্তি শূন্যের কোঠায় চলে যাবে। হাদিস শরিফে আছে ‘মান ইয়াস্তাওয়া ইয়াওমাহু যার দুটি দিন সমান যায় ফাহুয়া মাগবুন। সে পতনের দ্বারপ্রান্তে’।
হজ করে এসে যদি আমরা আগের মতোই জীবনযাপন করি যে গর্হিত কাজ থেকে তাওবা করে এসেছি কাবা স্পর্শ করে আরাফাত মিনা মুজদালিফায় উকুফ করে পাপ থেকে দূরে না থাকলে হজ হবে মূল্যহীন। হজ আমাদের শেখায় ধৈর্য সহমর্মিতা।
হজ শেষে আমাদের হিসাব করতে হবে কতটুকু সহনশীল হতে পেরেছি। যদি না হতে পারি বুঝতে হবে হজের সৎ গুণগুলো আমাদের স্পর্শ করেনি। আমরা হজ থেকে মোহাম্মদী তাকওয়া ইবরাহিমী ত্যাগ অর্জন করতে পারিনি। আমরা শুধু নামের হাজী হয়েছি। প্রকৃত হজ হল মানবতার খেদমতে কাজ করার নাম।
Email :mueenchishishty@gmail.com