বিসিক চামড়া শিল্পনগরী : দুর্বল অবকাঠামোয় নাখোশ ক্রেতারা

আপডেট : ১৮ আগস্ট, ২০১৮
বিসিক চামড়া শিল্পনগরী : দুর্বল অবকাঠামোয় নাখোশ ক্রেতারা

পরিবেশসম্মত ও পরিকল্পিত উৎপাদনে সার্বিক অবকাঠামোগত সহায়তা দেয়ার প্রতিশ্রুতি ছিল সাভারের বিসিক চামড়া শিল্পনগরীর। উদ্দেশ্য ছিল রাজধানীর হাজারীবাগের অপরিকল্পিত উৎপাদন বন্ধ করে কমপ্লায়েন্সনির্ভর এ শিল্পনগরীর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্রেতাদের বাংলাদেশমুখী করা এবং রফতানি বহুগুণ বাড়ানো।

অনুমোদিত ১৫৪ শিল্প প্লটের ১১৫ ট্যানারিই এরই মধ্যে বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করেছে। তবে আন্তর্জাতিক মানদণ্ড বজায় রেখে দূষণমুক্ত উৎপাদন এখনও শুরু হয়নি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর বড় কারণ অবকাঠামোগত দুর্বলতা। এর সঙ্গে রয়েছে বিসিক ও ট্যানারিগুলোর ব্যবস্থাপনা ত্রুটি। ফলে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের ক্রেতাদের মাথাব্যথা থেকেই গেছে। হাজারীবাগ নিয়ে তাদের অসন্তুষ্টির অন্ত ছিল না। নতুন চামড়া শিল্পনগরী থেকে দুই বছরেও তাদের প্রত্যাশার ছিটেফোঁটা পূরণ না হওয়ায় তারা এখন চরম হতাশ। বিশ্বের বড় ক্রেতাদেশগুলো তাই বাংলাদেশ ছাড়ার হুমকি দিচ্ছে। এরই মধ্যে চামড়াজাত পণ্য আমদানি করতে অপারগতা জানিয়েছে ইতালি। তারা ১২০ কোটি টাকার দুটি রফতানি আদেশ প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

ইউরোপীয় ইউনিয়ন শেষবারের মতো ৬০ দিন সময় দিয়ে জানিয়েছে, এর মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি না হলে তারা চামড়াজাত পণ্য কেনা বন্ধ করে দেবে। একই পথ এখন অন্যদেশগুলোও অনুসরণের পরিকল্পনা নিচ্ছে। ফলে রফতানি বৃদ্ধি বা বিদেশি বিনিয়োগ তো দূরের কথা, উল্টো বিদ্যমান রফতানি বাজার ও বহু বছরের স্থায়ী ক্রেতাদের ধরে রাখাই চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এ শিল্পনগরী ঘুরেও দেখা মিলল সেই বাস্তবতার। হেমায়েতপুরের বাঘমারা দিয়ে ট্যানারিতে যাওয়ার বন্ধুর পথই ক্রেতাদের নিরুৎসাহিত হওয়ার জন্য যথেষ্ট। আর প্রকল্পের ভেতরে অপ্রশস্ত এবড়োখেবড়ো সড়ক, দুর্বল ড্রেনেজ ব্যবস্থা, অপরিচ্ছন্ন পরিবেশ, ভয়াবহ দুর্গন্ধ, বৃষ্টির পানি উপচে যাওয়া, বর্জ্য ও উৎপাদিত পণ্যের টুকরো কারখানার বাইরে পড়ে থাকাই এখানে নিত্য চিত্র।

প্রবেশ সড়কের ২ হাজার ৩৮৫ ফুট এবং তার বাইরে ৮৩ হাজার ৬৯৬ বর্গমিটার রাস্তা নির্মিত হয়েছে ২০০৩ সালে। তবে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, আধুনিক চামড়া শিল্পনগরীর উপযোগী, মানসম্মত ও উপযুক্ত ভার নেয়ার সড়ক নেই এক মিটারও। মূল সড়ক থেকে ট্যানারির সব ব্লকের সব সড়কই সরু। সড়কজুড়েই খানাখন্দ বলে দিচ্ছে কাজের মান কেমন। ভাঙা অংশ দেখিয়ে দিচ্ছে ইটের সুরকির ওপর আধা ইঞ্চিও পিচ ঢালাই হয়নি। এসব সড়ক পুরোপুরি ব্যবহার অনুপযোগী।

শুধু সড়কই নয়, শিল্পনগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধনাগার (কমন ইফ্লুয়েন্ট ট্রিটমেন্ট প্লান্ট-সিইটিপি), ডাম্পিং ইয়ার্ড, সুয়ারেজ ট্রিটমেন্ট প্লান্ট (এসটিপি), স্লাস পাওয়ার জেনারেশন সিস্টেম (এসপিজিএস), সলিড ওয়াস্ট ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম (এসডব্লিউএমএস)- কোনোকিছুই ছোঁয়নি আন্তর্জাতিক মানদণ্ড।

পরিবেশসম্মত চামড়া শিল্পনগরীর জন্য এসব গুরুত্বপূর্ণ সূচকের অধিকাংশেরই কাজ এখন পর্যন্ত শেষ হয়নি। আবার এগুলোর যেসব অঙ্গের নির্মাণ শেষ হয়েছে, সেগুলো উৎপাদনে যাওয়ামাত্রই পুননির্মাণ বা সংস্কারের চাহিদা জানান দিচ্ছে।

সিইটিপি নির্মাণে মানহীন পণ্য ব্যবহারের অভিযোগ শিল্প মন্ত্রণালয়ই খতিয়ে দেখছে। বর্জ্য পরিশোধন ব্যবস্থাপনায়ও রয়েছে ত্রুটি। রির্জাভ ট্যাংকের ধারণক্ষমতা কম থাকায় বৃষ্টি হলেই বিষাক্ত পানি ও বর্জ্য উপচে বের হয়ে যাচ্ছে। শোধনাগারের চারটি মডিউলের দুটি পুরোপুরি এবং দুটি প্রস্তুতিমূলক চালু করা হলেও সেখানে এখনও সব কারিগরি যন্ত্রপাতি বসানো শেষ হয়নি।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সিইটিপির ২১ অঙ্গের ১৬টির কাজ ৩০ জুলাই পর্যন্ত সর্বোচ্চ ৯৭ শতাংশ শেষ হয়েছে। বাকিগুলোর কাজ ৫-১৩ শতাংশ বাকি রয়েছে। প্রি-ইকোয়ালাইজেশন ট্যাংকে শেষ দুটি মডিউলে স্লাস পরিশোধনের জন্য অক্সিজেশন ডিক্সের (১-৪ পর্যন্ত) পরীক্ষামূলক প্রস্তুতি চলছে। এসপিজিএস নির্মাণের কাজও খানিকটা বাকি। কমন ক্রোমিং রিসিভিং ইউনিটের তিন প্রকল্পের কাজ ২ থেকে ৭ শতাংশ অসম্পন্ন রয়েছে।

আর শিল্পনগরীর গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ও আন্তর্জাতিক সূচকে অন্যতম বিবেচ্য মানদণ্ড শ্রমিকদের থাকার বাসস্থান, হাসপাতাল, দিবাযত্ন কেন্দ্র, বিনোদন কেন্দ্র এখন পর্যন্ত নির্মাণ পরিকল্পনায়ই নেই। সীমানাপ্রাচীরের নির্মাণকাজ গত বছর কোরবানির মৌসুম পর্যন্ত পর্যন্ত ৮২ শতাংশ শেষ হয়। বাকি ১৮ শতাংশের কাজ এক বছরেও এগোয়নি। দৈনিক ২৩শ’ মিলিয়ন লিটার ক্ষমতাসম্পন্ন কেন্দ্রীয় পানি সরবরাহ ব্যবস্থার কাজও শেষ হয়নি।

প্রশাসনিক ভবন নির্মাণে ২য় স্তরের কাজ বাকি ৭০ ভাগ। পুলিশ ফাঁড়ি তৈরি হলেও তা কার্যক্রম শুরুর আগেই মেরামতের সময় হয়ে গেছে। ফায়ার ব্রিগেড শেড তৈরি হয়েছে, কিন্তু সেটা আধুনিক ফায়ার ব্রিগেডের ধারেকাছে নেই।

এসব নিয়ে জানতে চাইলে বিসিক চামড়া শিল্পনগরীর প্রকল্প পরিচালক শাব্বির আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, বাংলাদেশে এই প্রথম এত বড় একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। এ বিষয়ে অভিজ্ঞতা ছিল না। এ কারণেই একটু সময় লাগছে। তবে প্রতিদিনই কাজের অগ্রগতি হচ্ছে।

এক প্রশ্নে তিনি বলেন, সিইটিপির কাজে যেটুকু দীর্ঘসূত্রতা আছে, তা শুধু ঠিকাধারি প্রতিষ্ঠানের জন্য। এটা কাটিয়ে ওঠা গেলে চারটি মডিউলই দ্রুত একসঙ্গে শতভাগ সক্ষমতা নিয়ে কাজ শুরু করতে পারবে। সড়ক অবকাঠামোর বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক বলেন, সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। আগামী মাসের মধ্যে সব সড়ক মানদণ্ডে উন্নীত হবে। তবে প্রবেশপথের সড়ক উন্নয়ন কাজ বিসিক না করে সড়ক উন্নয়ন কর্তৃপক্ষকে দিয়ে করালেই ভালো হবে। এ বিষয়ে প্রস্তাব পাঠানো হচ্ছে।

এ নিয়ে কথা হয় শিল্প সচিব মোহাম্মদ আবদুল্লাহর সঙ্গে। তিনি বলেন, প্রকল্পের মেয়াদ ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত রয়েছে। যেহেতু উন্নয়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। তাই এ সময়ের মধ্যে পুরো শিল্পনগরীর চেহারা আমূল পাল্টে যাবে। এটি আধুনিক ও আন্তর্জাতিকমানের করতে যেখানে যা প্রয়োজন, তার সবই করা হবে। এ লক্ষ্যে প্রকল্পের অগ্রগতি কার্যক্রম নিবিড়ভাবে মনিটরিং করা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর অগ্রাধিকারভুক্ত জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ এ প্রকল্পের কার্যক্রম কোনোভাবেই আমরা ব্যাহত হতে দেব না।