বিশেষ প্রতিবেদনঃ বাংলাদেশের কাছে আগামী ৫ অক্টোবর রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রথম ইউনিটের জন্য ইউরেনিয়াম (বিদ্যুৎ কেন্দ্রের জ্বালানি) হস্তান্তর করছে রাশিয়া। আর মাত্র এক সপ্তাহ পরেই অর্থাৎ চলতি মাসের ২৮ তারিখ কাক্সিক্ষত ইউরেনিয়াম এসে পৌঁছাবে বাংলাদেশে। আর এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ পারমাণবিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাবে। দেশের মানুষ তাদের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের স্বপ্নপূরণের দোরগোড়ায় চলে যাবে। ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠান উপলক্ষে আগামী ৫ অক্টোবর দুপুরে ভার্চুয়ালি এক বৈঠকে অংশ নেবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় পারমাণবিক সংস্থা-রোসাটম এবং রূপপুর প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। অনুষ্ঠানে আন্তর্জাতিক পরমাণু শক্তি সংস্থা (আইএইএ)-এর মহাপরিচালক রাফায়েল মারিয়ানো গ্রসিও-এরও ভার্চুয়ালি যুক্ত হওয়ার কথা রয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইউরেনিয়াম হস্তান্তর অনুষ্ঠান উপলক্ষে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্টরা প্রস্তুতি নিচ্ছেন। জ্বালানি হস্তান্তরের আগে চলতি মাসের ২৮ তারিখে দেশে ইউরেনিয়াম পৌঁছানোর কথা রয়েছে। আর ৫ অক্টোবর আনুষ্ঠানিকভাবে অনুষ্ঠিত হবে এই জ্বালানি হস্তান্তর অনুষ্ঠান। গত রবিবার বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে এ অনুষ্ঠান উপলক্ষে এক বৈঠক হয়। সেখানে সংশ্লিষ্টরা অনুষ্ঠানটি আয়োজনে বিস্তারিত আলোচনা করেন। অনুষ্ঠানে সরাসরি উপস্থিত থাকবেন রোসাটমের মহাপরিচালক আলেক্সি লিখাচেভ, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমন্ত্রী স্থপতি ইয়াফেস ওসমানসহ, রোসাটম ও প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।
জানা যায়, রাশিয়া থেকে বিশেষ বিমানে সাতটি চালানের মাধ্যমে ইউরেনিয়াম বাংলাদেশে আসবে। যা দিয়ে এক বছর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যাবে। এরপর ধাপে ধাপে জ্বালানি আসবে। গ্রিডলাইন প্রস্তুত হওয়ার পর চুল্লিতে জ্বালানি লোড করা হবে। এরপর বিদ্যুৎ উৎপাদন শুরু করতে দুই মাস লাগবে। উৎপাদন শুরুর পর পূর্ণ সক্ষমতা চালাতে ৯ থেকে ১০ মাস লাগবে।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা জানান, একটি দেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র প্রকল্প এলাকায় জ্বালানি এসে পৌঁছালে তখন দেশটি আন্তর্জাতিক নিউক্লিয়ার ক্লাবে অন্তর্র্ভুক্ত হয়। এই হিসেবে আসছে অক্টোবরে বাংলাদেশও আনুষ্ঠানিকভাবে আন্তর্জাতিক নিউক্লিয়ার ক্লাবের সদস্য হওয়ার সম্মান অর্জন করবে।
বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রকল্প পরিচালক ড. মো. শৌকত আকবর বলেন, নীতিগত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আসছে ৫ অক্টোবর রাশিয়া, বাংলাদেশের কাছে ইউরেনিয়াম হস্তান্তর করবে। জ্বালানি হস্তান্তরের পরই শুরু হবে বিদ্যুৎ উৎপাদন পরীক্ষা। বিদ্যুৎ সঞ্চালন লাইন নির্মাণের অগ্রগতির ওপর ভিত্তি করে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্তে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিট বাণিজ্যিক উৎপাদন শুরু করবে বলে আশা করা হচ্ছে। তিনি জানান, ইউরেনিয়াম আসার পরও বেশ কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষার ব্যাপার আছে। এই ধাপগুলো অতিক্রম করার পর কেন্দ্রটি উৎপাদনে যাবে। ইউরেনিয়াম আসার পর আমরা রিয়্যাক্টর সিস্টেমের পূর্ণাঙ্গ কার্যক্রমের পরীক্ষা করার প্রস্তুতি নিচ্ছি। ইউরেনিয়ামের সঙ্গে ডামি ফুয়েলও আসছে। প্রথমে ডামি ফুয়েল দিয়ে রিয়্যাক্টর চালিয়ে দেখা হবে সব ঠিক আছে কি না। সব ঠিক থাকলে তারপর ইউরেনিয়াম দেওয়া হবে। একটি দেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে ইউরেনিয়াম যাওয়ার অর্থ হচ্ছে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির নির্মাণকাজ অপারেশন ইউনিটে উন্নীত হয়েছে। আর এটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বেশ কয়েকটি পরীক্ষা পার হয়ে আসতে হচ্ছে। এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটির জন্য যে প্রযুক্তি সরবরাহকারী দেশ তার রপ্তানি কন্ট্রোল নীতি অনুসারে আমার দেশের সব সেফটি সিকিউরিটি নিশ্চিত আছে কি না তা নিশ্চিত হওয়ার পরই ইউরেনিয়াম দেশে আসবে। আমরা সব নিরাপত্তা ব্যবস্থা পর্যায়ক্রমে অতিক্রম করে এই জ্বালানি আনতে যাচ্ছি। এর মাধ্যমে রাষ্ট্র প্রথমবারের মতো পারমাণবিক জ্বালানির মালিক হচ্ছে। এই জ্বালানি আমদানির মধ্য দিয়ে রূপপুর বিদ্যুৎ নির্মাণ প্রকল্প পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে উন্নীত হবে।
প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় ও প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের তথ্যে, বিশেষ বিমানে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে এ জ্বালানি বাংলাদেশে আমদানির পর তা রূপপুরে পৌঁছানো হবে। এরই মধ্যে আমদানি প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে বিমান পরিবহন চুক্তি সম্পন্ন হয়েছে। পারমাণবিক জ্বালানি সরবরাহের জন্য প্রয়োজনীয় দলিল অনুমোদনের পাশাপাশি এই কাজের সঙ্গে যে বা যারা যুক্ত এমন জনবল নিয়োগ চূড়ান্ত করা হয়েছে।পারমাণবিক কেন্দ্রে জ্বালানি পৌঁছানোর পর তা হস্তান্তর ও পরিচালনার সময় যে কোনো ধরনের দুর্ঘটনা এড়াতে বিশেষ দল গঠন করা হয়েছে। পর্যাপ্ত নিরাপত্তার মধ্য দিয়েই জ্বালানি বিনিময় ও ব্যবস্থাপনার ব্যাপারে সব ধরনের প্রস্তুতি নিয়েছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা। প্রসঙ্গত, রূপপুর প্রকল্পের মোট নির্মাণ ব্যয় ১২.৬৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। এর মধ্যে রাশিয়া শতকরা ৯০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় ১১.৩৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। এই বিনিয়োগের শর্ত হচ্ছে, মূল বিনিয়োগসহ সর্বোচ্চ ৪% সুদে ২৮ বছরে পরিশোধ করতে হবে এবং প্রয়োজনে আরও ১০ বছরের সময় বৃদ্ধি করার সুযোগ রয়েছে। প্রকল্পের বাকি ১০ শতাংশ ব্যয় অর্থাৎ, ১.২৬ বিলিয়ন ডলার বাংলাদেশ নিজস্ব তহবিল থেকে বহন করবে।